মোঃ বশির আহাম্মেদ ঃ এমন কোনো তদবির নাই যা তিনি পারেন না! সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ঠিকাদারী কাজ পাইয়ে দেওয়াসহ যে কোনো মামলায় দেশের যে কোনো আদালত থেকে জামিন করিয়ে দেওয়া সবই তার হাতের মুঠোয়। এমন অসংখ্য ক্ষমতার অধিকারী জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক পরিচয়ধারী ও ভুয়া ব্যারিস্টার প্রিন্স এলাহী। আর এভাবেই নিজেকে আওয়ামী রাজনীতির ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকার কথা উল্লেখ করে সারাদেশে ছড়িয়েছেন প্রতারণার মিশন।
প্রতারণার সম্রাট ভুয়া ব্যারিস্টার প্রিন্সের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানাধীন বড় রঘুনাথপুর গ্রামের মোঃ হাবিবুর রহমান মাস্টারের পুত্র এই প্রতারক প্রিন্স কামরান ওরফে ব্যারিস্টার প্রিন্স ইলাহী।
এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তদবিরের প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এই ভুয়া ব্যারিস্টার। কথিত এই নেতা পরিচয়ধারী বর্তমানে লোকচক্ষুর আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
জানা গেছে, এসব কর্মকাণ্ডে সহযোগী হিসেবে তার ছোট ভাইসহ একটি সিন্ডিকেট কাজ করতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সময়ে দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা বাস্তবায়নে কঠোর ঠিক সেই সময়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে সারাদেশে অসংখ্য মানুষকে প্রতারিত করে যাচ্ছেন প্রিন্স এলাহী।
প্রতারক প্রিন্স এলাহীর শিক্ষা যোগ্যতা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, ২০০২ সালে ৩.১৩ পেয়ে এসএসসি (রোলঃ ৫৬১৭০১)। দুইবার ফেল করে ২০০৬ সালে তৃতীয় বারে ৩.১০ পেয়ে এইচএইসসি (রোলঃ ৮০৪৬৮৯) পাশ করেন। অথচ এই প্রতারক নিজের নামের পাশে ব্যারিস্টার ডিগ্রী লাগিয়ে ও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নামে সংগঠনের নেতা পরিচয় দিয়ে গ্রাম্য সহজ সরল মানুষের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তিনি ব্যারিস্টারি না পড়েও নিজের নামের সাথে নিয়মিত ব্যারিস্টার লিখে প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে।
প্রিন্স এলাহীর পাসপোর্ট নং-BF0753736। সেখানে যুক্তরাজ্যের ভিসার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস এর চারটি ইনস অফ কোর্ট এবং বার কাউন্সিল অফ ইউকে তে আলাদা আলাদা ইমেইল দিয়ে ব্যারিস্টার প্রিন্স ইলাহী বা প্রিন্স কামরান নামে মেম্বারশিপের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদস্থ ব্যক্তিদের সাথে সুকৌশলে ছবি তুলে তা গ্রাম্য সহজ সরল মানুষগুলোকে দেখিয়ে তাদেরকে চাকুরি দেয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এছাড়াও টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেয়ার নামেও বিভিন্ন মানুষের কাছে থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলেও উক্ত সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে সারাদেশে বিভিন্ন কমিটি দিয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তার প্রতারণার কবল থেকে বাদ যায়নি নিজের গ্রামের নিরীহ মানুষেরাও। তার গ্রামের লোকদের কাছে সে ব্যারিস্টার প্রিন্স এলাহী এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সেজে বিভিন্ন তদবিরের কাজে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
একটি সূত্র জানায়, তার এ প্রতারণার শিকার সারাদেশে শত শত ব্যক্তি। যাদের থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। যেই টাকায় তিনি গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন বিলাশবহুল বাড়ি।
এছাড়াও ব্যারিস্টার পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন সার্কিট হাউজেও অবস্থান করার তথ্য পাওয়া গেছে। এই প্রতারকের আপন ছোট ভাই মোঃ সজলকে উক্ত সংগঠনের অর্থ সম্পাদকের পরিচয় দিয়ে কমিটি দেয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের নামে অনেকেই প্রচার প্রচারণা এবং এর সভাপতি ও সেক্রেটারী দাবি করলেও প্রিন্স এলাহী নিযুক্ত সংগঠনে কোনো পদে বহাল নেই।
তার প্রতারণার শিকার একই এলাকার বাসিন্দা হাসান মাহমুদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রিন্স কামরান ওরফে ব্যারিস্টার প্রিন্স ইলাহী আসলে ভুয়া ব্যারিস্টার। কেউ বলতে পারে না তিনি কবে, কোথা থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেছেন। তার প্রকৃত নাম প্রিন্স কামরান। তার বাবা স্কুল শিক্ষক হাবীবুর রহমান।
হাসান মাহমুদ আরো বলেন, বরিশাল আদালতে চাকরি হবে এমন আশ্বাস দিয়ে ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চার লাখ টাকা নেন প্রিন্স। পালিত গরু বিক্রি করে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। ৮০ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে মোট তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা তাকে দেই। এরপর আবারও টাকা চাইলে যত গাছ-গাছালি আর হাঁস-মুরগী ছিল সব বিক্রি করে বাকি ৪০ হাজার টাকাও দেই। সেটা ২০১৬ সালের কথা। সব টাকা বুঝে নিলেও আমরা চাকরি এখনো হয়নি। সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে সংসারও চলে না। কিছুদিন আগে আমার মা স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছেন। টাকা চাইতে গেলে উল্টো মামলার ভয় দেখান। বন্ধক জমি কোনো দিন বের করতে পারব কি না, তাও জানি না। এখন আর গরু পালার মতো টাকাও নেই। আর বেশিরভাগ সময় প্রিন্সের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকে। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিকট এ বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায়নি।
আরেক ভুক্তভোগী মো. রিপন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, আমাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমএলএসএস পদে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রিন্স। চাকরি না পাওয়ায় তার কাছে টাকা ফেরত চাইলে উল্টো আমাকেই পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বলে, আমি একজন ব্যারিস্টার। জানিস কত কিছু করতে পারি?
আরেক ভুক্তভোগী দুলাল হোসেন বলেন, আমার ছোট ভাইকে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে নিয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। ২০১৭ সালে সেই টাকা দিয়েছি। এখন ২০২০ সাল। চাকরিও নেই, টাকাও নেই। টাকা চাইলে বলেন, টাকা দেবে। কিন্তু আজকাল করতে করতেই বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে। আমাদের সর্বস্ব হারিয়ে আমরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছি।
আবু বকর নামে আরো একজন ভুক্তভোগী বলেন, আমার কাছে থেকে ব্যাংকে চাকরি দেয়ার নামে নিয়েছে তিন লাখ টাকা টাকা দিবে দিবে বলে আর দিচ্ছেনা এখন টাকা চাইতে গেলে উলটো হুমকি দিচ্ছে।জালাল গাজী নামে