নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু, ছাত্র-শিক্ষক, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন রাজধানীবাসী। বিগত এক দেড় মাস ধরে বাড়ছে চিক?ুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ভাইরাস বহনকারী মশা নিধনে রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা ও জনসচেতনতার কারণে চিক?ুনগুনিয়ার প্রকোপ আরও বেড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। খবর বাংলানিউজ।গতকাল বুধবার রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসক ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে কথা হয়।
চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিক?ুনগুনিয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও প্রতিরোধের বিস্তারিত তথ্য না থাকায় রোগটির প্রকোপ বেড়েই চলেছে। পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত না হন সেই বিষয়ে কোনো পরামর্শ নেই আক্রান্তদের কাছে। ফলে পরিবারের একজনের হলেই বাকিরাও একই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
মো. ফজলে রাব্বী রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি এক সপ্তাহ ধরে চিকুনগুনিয়ায় ভুগছেন। রাব্বী বলেন, আক্রান্ত হওয়ার আগে এই ভাইরাস সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। প্রথম দুই দিন মনে করেছিলাম সাধারণ জ্বর। পরে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি চিক?ুনগুনিয়া। ভাইরাসটি কেন হয় এবং কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, সেই তথ্য না থাকায় পরিবারের আরও দুই সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন।
কেরানীগঞ্জের বসিলার বেল্লা হোসেন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তিনি বলেন, এই রোগের নাম কোনো দিন শুনিনি। হাসপাতালে এসে শুনলাম এডিস মশার কামড়ে নাকি এই রোগ হয়। আমার এলাকায় মশার উৎপাতে সবাই অতিষ্ঠ। কিন্তু কোনো দিনও দেখিনি সরকারি কোনো লোক মশা নিধনের ওষুধ দিচ্ছে বা এই ব্যাপারে আমাদের সচেতন করেছে।
মশা নিধনে ব্যর্থতাসহ সচেতনতা বৃদ্ধি না করায় চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। একটি বেসরকারি হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, আমাদের হাসপাতালে যতটি চিকুনগুনিয়ার কেস এসেছে তারা কেউ এই ভাইরাস সম্পর্কে জানেন না। চিকুনগুনিয়ায় বিশ্রাম ছাড়া অন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকায় রোগীরা হাসপাতালে কম ভর্তি হচ্ছেন।
ফলে সঠিক সংখ্যা না বলা গেলেও আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অধিকাংশই এই ভাইরাসে আক্রান্ত। দ্রুত এই ভাইরাস প্রতিরোধে কিছু না করা গেলে রোগটির প্রাদুর্ভাব আরও বেড়ে যাবে। চিক?ুনগুনিয়া প্রতিরোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা।রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা স্বপন মিয়া বলেন, এই শহরের এমন কোনো জায়গা আছে যে বৃষ্টি হলে পানি জমে না? সিটি কর্পোরেশন কয় দিন মশক নিধনের স্প্রে করে? তাহলে চিকুনগুনিয়া বাড়বে না তো কী হবে? এছাড়া এডিস মশার কামড়ে যে এই ভাইরাস ছড়ায় তাও কয়জন জানে। এখন ঘরে ঘরে মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে তাই প্রশাসন কিছুটা কাজ দেখানোর চেষ্টা করছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানুল আহসান বিপুল বলেন, প্রতিদিন আমাদের কাছে আসা শিশু রোগীদের মধ্যে ৫০-৬০ শতাংশ রোগী বিভিন্ন ভাইরাসের জ্বর নিয়ে আসছে। এর মধ্যে কিছু কিছু কেস চিকুনগুনিয়ারও রয়েছে। এছাড়া জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই দুইটি ভাইরাসই এডিস মশা বহন করে। তাই আমাদের সবাইকে আরও বেশি সচেতন হবে।
চিকুনগুনিয়ার প্রকোপের কারণে রাজধানীর ফার্মেসিগুলোতে জ্বরের ওষুধের স্বল্পতাও দেখা দিয়েছে। রাজধানীর একটি ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা জুয়েল রানা বলেন, চিকুনগুনিয়ার কারণে জ্বরের ওষুধের সঙ্কট রয়েছে। ন্যাপা, ন্যাপা এক্সট্রা, প্যারাসিটামল ও সাপোজিটরির চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমদাদুল হক বলেন, মশক নিধনে স্প্রে’র পরিমাণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা হলো ডমেস্টিক মশা। রাস্তা-ঘাটে স্প্রে করা হচ্ছে, ঘরে ঘরে তো সম্ভব না।
তাই এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন হতে হবে।রাজধানীজুড়ে চলা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও সংস্কার কাজের জন্য সৃষ্ট খানা-খন্দে বৃষ্টির পানি জমেও জীবাণুবাহী মশা বংশ বিস্তার করছে বলেও জানান সিটি কর্পোরেশনের এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।মশক নিধনে হতাশামশক নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতায় হতাশা প্রকাশ করে লালবাগের বাসিন্দা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘সারাদিনই বাসার ভেতর ও গলিতে মশার যন্ত্রণায় বসা যায় না। আগে সপ্তাহে একবার হলেও সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে স্প্রে করতো এখন আর দেখা যায় না তাদের।
হঠাৎ দুই একদিন আসলেও গলির মাথায় স্প্রে করেই চলে যায় ভেতরে আসেন না তারা।’উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন কাঁঠাল বাগান এলাকা এডিস মশার প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি। এই এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, ‘এখানে সারা বছরই মশার কামড় খেতে হয়। আর বর্ষা এলেতো কথাই নেই। কিন্তু মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না।’চিকুনগুনিয়া রোগে দুই একজনের মারা যাওয়ার খবর শুনলেও সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই বলে মনে করেন দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তাদের দাবি শুধু চিকুনগুনিয়ায় মারা গেছে এটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম এম সালেহ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের মশক নিধনের নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এমন না যে গতবারের চাইতে এবার কম কাজ হচ্ছে। যেহেতু চিকুনগুনিয়া রোগটি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন, তাই বেশি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। আর এ রোগ একবার হলে দ্বিতীয়বার হওয়ার সুযোগ নেই।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাউদ্দিন বলেন, চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশা তাড়াতে আমাদের লোকবল বৃদ্ধি করেছি। অস্থায়ী ভিত্তিতে ১০৮ জন মশক নিধনকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।