মো. লালন উদ্দীন, বাঘা (রাজশাহী) : রাজশাহীর বাঘার জীবন সংগ্রামে টিকতে অটোরিকশা চালাচ্ছেন জায়েদা বেগম নামে এক নারী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা দুমুঠো ভাতের জন্য কিস্তিতে কেনা অটো নিয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে বেড়ান তিনি।
জানা যায়, বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের জোতকাদিরপুর গ্রামে জায়েদা বেগমের বাড়ি। জায়দা বেগম জীবন-জীবিকার তাগিদে গৃহিণী থেকে ধরেছেন অটোর স্টিয়ারিং। সমাজে পুরুষের পাশাপাশি জায়েদা বেগম মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
তার স্বামী শাহ জামাল আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। আর তাকে তালাক দিয়েছে। তারপর তিনি নিরুপায় হয়ে পড়েন। অবশেষে অটো চালানোর পেশা বেছে নিয়েছেন। জায়দা বেগমের জন্ম দরিদ্র পরিবারে। অন্যদিকে কালো চেহারার বলে কেউ বিয়ে করতে চায়নি। ফলে ৩০ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বছরখানেক সংসার করেন। তারপর অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন স্বামী অন্যত্র চলে যায়। তখন জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন।
এর মধ্যে জন্ম নেয় পুত্রসন্তান। অভাবী সংসারে ভারতের সীমান্তবর্তী পদ্মার দুর্গম বাংলাবাজার চর ছেড়ে ছেলে জায়দুল হককে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ১০ বছর আগে চলে আসেন উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের জোতকাদিরপুর গ্রামে। এই গ্রামে ৫ কাঠা জমি কিনে শুরু করেন নতুন জীবন। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদে কোনো পেশাকে ছোট করে দেখেননি জায়েদা বেগম। এভাবেই পার করেন জীবনের ৫০ বছর।
স্থানীয় এক এনজিও থেকে কিস্তিতে ৩২ হাজার টাকা নিয়ে প্রথমে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান কেনেন। নিজ এলাকায় কয়েকদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাস্তায় নামেন ভ্যান নিয়ে। বর্তমানে ওই ভ্যান বিক্রি করে অটো কেনেন তিনি। যাত্রী পরিবহন করে প্রতিদিন আয় হয় প্রায় ২৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা। প্রতিদিনের ব্যাটারি চার্জ বাবদ ৫০ টাকা। বর্তমানে ছেলেসহ দুজনের সংসার মোটামুটি চলে তার। এছাড়া সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা দিতে কোনো অসুবিধা হয় না। খরচবাদে বাড়তি কিছু টাকা জমাও করেন প্রতিদিন। আর্থিক অনটনের মধ্যেও ছেলেকে লেখাপাড়া করাচ্ছেন স্থানীয় স্কুলে। ছেলে জায়দুল হকের বয়স ১৩ বছর। বর্তমানে ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিজে লেখাপড়া জানে না। তার ইচ্ছা ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা।
জায়েদা বেগম বলেন, দেশে বিভিন্ন যানবাহনে পেশাদার নারীচালক আরো দরকার। নারীদের জন্য পরিবহনের বিশেষ কোনো সুবিধা নেই। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে নারী ড্রাইভিংয়ের চালক বৃদ্ধি পাবে। পাকুড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম মেরাজ বলেন, বর্তমানে রাস্তায় যে হারে দুর্ঘটনা হয়। নারীরা সহজে ধৈর্যহারা হয় না। ওভারটেক করার প্রবণতা থাকে না। সে ক্ষেত্রে নারীরা গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাবে। গাড়িচালক হিসেবে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি নিরাপদ। ফলে রাস্তায় গাড়ি চালনায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।
স্থানীয় বেসরকারি স্বউন্নয়নের প্রকল্প কর্মকর্তা আবু বাক্কার সিদ্দিকী বলেন, খামখেয়ালি স্বভাব আর অকারণে ধৈর্যহারা হওয়ার প্রবণতা নারীদের তুলনায় পুরুষের বেশি। তাই স্টিয়ারিং হুইলে নারীর হাতটিই নিরাপদ মনে হয়। গ্রামের নারীরা আগের চেয়ে উন্নত হলেও সার্বিকভাবে তারা এখনও প্রান্তিক পর্যায়েই রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। যেকোনো সাহসী পেশাতে নারীদের এগিয়ে আসলেই পরিবেশ পরিবর্তন হবে।